রোকন শেখ
প্রকাশ: ১৯:২১, ২৫ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ১৯:৩৯, ২৫ অক্টোবর ২০২৫
ছবি: সংগৃহীত
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল— বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসে এটি এক বিশেষ সময়। স্বাধীনতার পর নানা উত্থান–পতনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলা দেশের খেলাধুলা তখন নতুন এক গতিপথে পা রাখে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়টিতে ক্রীড়া শুধু শহুরে বিনোদনের সীমায় থাকেনি; বরং রাষ্ট্রীয় ভাবমূর্তি ও জাতীয় গর্বের প্রতীকে রূপ নেয়।
ক্রিকেটে আত্মবিশ্বাসের সূচনা
২০০০ সালে টেস্ট মর্যাদা পাওয়া বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রকৃত অর্থে গতি পায় বিএনপি সরকারের আমলেই। ২০০৫ সালে কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো ছিল দেশের জন্য এক ঐতিহাসিক ঘটনা— যা বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের অবস্থান বদলে দেয়। একই বছর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে সিরিজ জয় আসে।
এই সময়েই উঠে আসে এক নতুন প্রজন্ম— মাশরাফি বিন মুর্তজা, আশরাফুল, আফতাব, রাজিন সালেহ, পরবর্তীতে সাকিব, মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ। এদের হাতেই গড়ে ওঠে বাংলাদেশের ক্রিকেটের নতুন যুগ।
তৎকালীন বিসিবি সভাপতি আরাফাত রহমান কোকোর নেতৃত্বে শুরু হয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন। মিরপুর শের–ই–বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সংস্কার, বিভাগীয় শহরে নতুন স্টেডিয়াম ও জেলা পর্যায়ে ক্রিকেট একাডেমি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ— সবই ছিল ভবিষ্যৎমুখী পরিকল্পনা। পরবর্তীকালে এই স্টেডিয়ামই হয়ে ওঠে বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রাণকেন্দ্র।
ফুটবলে নতুন জাগরণ, তবে স্থায়িত্বের অভাব
ফুটবলেও তখন একধরনের উত্থান দেখা দেয়। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজন, ন্যাশনাল লীগ (বর্তমানে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ) নিয়মিত করা, এবং স্কুল–কলেজ পর্যায়ে প্রতিযোগিতা চালু করা— এসব উদ্যোগ তরুণ প্রতিভা বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
তবে সাফল্য স্থায়ী হয়নি। গোলরক্ষক আমিনুল হকের নেতৃত্বে সাফ গেমসে ভালো পারফরম্যান্স থাকলেও পরবর্তী সময়ে ফুটবল তার ধারাবাহিকতা হারিয়ে ফেলে প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে।
জাতীয় খেলা কাবাডি ও হকিতে প্রাণচাঞ্চল্য
জাতীয় খেলা কাবাডিতে সরকার বাড়তি পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। উপজেলা ও গ্রামীণ পর্যায়ে কাবাডি প্রতিযোগিতা আয়োজন, খেলোয়াড়দের পুরস্কার প্রদান, এবং সাউথ এশিয়ান গেমসে পদক অর্জনের ধারা অব্যাহত থাকে।
হকিতেও ঢাকায় আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজন ও জাতীয় দলের প্রশিক্ষণ উন্নয়নের মধ্য দিয়ে নতুন উদ্যম দেখা যায়। নারী খেলোয়াড়দের অংশগ্রহণ বাড়ে, যা ছিল সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
বিএনপি সরকারের সময় ক্রীড়াঙ্গনে নেওয়া কিছু পদক্ষেপ আজও উদাহরণ হয়ে আছে, যেমন-
# জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে স্টেডিয়াম ও ইনডোর জিমনেসিয়াম নির্মাণ।
# ক্রীড়াবিদদের আর্থিক সহায়তা ও পুরস্কার প্রবর্তন।
# জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ও অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন পুনরুজ্জীবন।
# স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে নিয়মিত ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন।
এসব পদক্ষেপ দেশের ক্রীড়াকে ‘শখের খেলা’ থেকে ‘পেশাদার খেলার’ দিকে নিয়ে যেতে সহায়তা করে।
পতন ও পুনর্জাগরণের বাস্তবতা
দুঃখজনকভাবে ২০০৬–এর পর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অদক্ষতায় ফুটবল, হকি ও কাবাডি ধীরে ধীরে পিছিয়ে যায়। কেবল ক্রিকেটই কিছুটা টিকে থাকতে পারে সেই সময়কার ভিত্তির কারণে।
তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর খেলাধুলায় নতুন প্রাণ সঞ্চার হচ্ছে। বাফুফে প্রেসিডেন্ট তাবিত আওয়ালের নেতৃত্বে ফুটবল ফিফার আস্থা ফিরে পেয়েছে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের খেলোয়াড় হামজা চৌধুরী ও প্রবাসী তরুণরা বাংলাদেশের হয়ে খেলার আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
যদিও ক্রিকেট বোর্ডে কিছু অনিয়ম এখনো রয়ে গেছে, তারপরও দেশের ক্রীড়াঙ্গনে ‘ঘুরে দাঁড়ানোর’ ইঙ্গিত স্পষ্ট।
আমার দৃষ্টিতে, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়টা ছিল বাংলাদেশের খেলাধুলার ‘ভিত্তি রচনার যুগ’। সেই সময়কার অবকাঠামো উন্নয়ন, খেলোয়াড় সনাক্তকরণ ও প্রশাসনিক সংস্কার আজকের সফলতার ভিত্তি স্থাপন করেছে।
যদি সেই দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বচ্ছতা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকে, তবে বাংলাদেশ কেবল ক্রিকেটে নয়— ফুটবল, হকি ও অন্যান্য খেলাতেও দক্ষিণ এশিয়ার নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে।
রোকন শেখ
তরুণ রাজনীতি বিশ্লেষক
উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়