ঢাকা, শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫

২০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

রূপনগরের আগুনে জ্বলছে আমাদের বিবেক

ওমর ফারুক

প্রকাশ: ১৮:২৮, ১৬ অক্টোবর ২০২৫

রূপনগরের আগুনে জ্বলছে আমাদের বিবেক

ওমর ফারুক। ছবি: ডেইলিদর্পণ

ঢাকা, যে শহর একসময় ছিল জীবনের প্রাণকেন্দ্র, আজ তা হয়ে উঠেছে মৃত্যুর ফাঁদ। রাজধানীর রূপনগরের শিয়ালবাড়ীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সেই সত্যটিকেই আবারও নির্মমভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। কেমিক্যাল গোডাউন এস আলম ট্রেডার্স থেকে সূত্রপাত হওয়া আগুনে পুড়ে মারা গেছেন অন্তত ১৬ জন শ্রমিক। অনেকেই এখনো নিখোঁজ। যাদের লাশ উদ্ধার হয়েছে, অধিকাংশই দগ্ধ হয়ে অচেনা। ডিএনএ পরীক্ষার পরেই পরিচয় জানা যাবে তাদের। আগুনের ধোঁয়া যেমন দম বন্ধ করে দিচ্ছে শিয়ালবাড়ীর বাতাস, তেমনি রাষ্ট্রের নিঃশ্বাসও যেন আটকে আছে দায় এড়ানোর ব্যস্ততায়।

ফায়ার সার্ভিসের রেকর্ড বলছে, এস আলম ট্রেডার্স কোনো অনুমোদনই নেয়নি। তাদের বিরুদ্ধে তিনবার নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। তারপরও গোডাউন চালু ছিল। প্রশাসন জানত, স্থানীয়রাও জানত, কিন্তু কেউ কিছু করেনি। এই শহরে এখন সবাই জানে যে অবৈধ কেমিক্যাল গুদামগুলো ঘরে ঘরে ছড়িয়ে আছে। কেউ মুখ খোলে না, কারণ সবাই জানে, আইনের চোখ বাঁধা। আগুনের লেলিহান শিখা যতটা ভয়ঙ্কর নয়, তার চেয়ে ভয়ঙ্কর আমাদের নীরবতা।

চকবাজার, নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গীতে প্রতি কয়েক মাস পরপরই আমরা দেখি একই ধরনের খবর: কেমিক্যাল, ফ্যাক্টরি, বিস্ফোরণ, আগুন, মৃত্যু, ডিএনএ টেস্ট। অথচ তদন্ত কমিটি, শোক বার্তা, ক্ষতিপূরণের ঘোষণা সবই যেন এক চিরপরিচিত নাটকের পুনঃপ্রচার।

প্রশ্ন হলো: কেন বারবার একই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে অথচ কিছুই বদলায় না?

উত্তরটি সহজ আমরা ঘটনাকে দুর্ঘটনা ভেবে ভুল করি। কিন্তু এগুলো দুর্ঘটনা নয়, এগুলো অপরাধ। অবৈধ গুদাম, অনুমোদনহীন ফ্যাক্টরি, ভবন কোড অমান্য করে তৈরি স্থাপনা এসবই হত্যা করার প্রস্তুতি। আর প্রশাসনের উদাসীনতা এই হত্যার সহযোগী।

রূপনগরের শিয়ালবাড়ী একটি আবাসিক এলাকা। অথচ তার মাঝখানে কেমিক্যালের গুদাম, পাশেই পোশাক কারখানা। এক গলিতে ১০–১৫টি এমন গুদাম। ট্রাক ঢোকার জায়গা নেই, ফায়ার সার্ভিস ঢুকতে পারে না, পানি সরবরাহ নেই। আগুন লাগলে কারও বাঁচার উপায় থাকে না।

এই শহর এমনভাবে গড়ে উঠেছে যেখানে মানুষের প্রাণের চেয়ে ব্যবসার স্বার্থ বড়। একসময় শহরকে বলা হতো “জীবনের রাজধানী”, এখন তা “মৃত্যুর অপেক্ষালয়”।

গোডাউন মালিক শাহে আলম এখন পলাতক। কিন্তু শুধু কি শাহে আলম দোষী?

দোষী সেই স্থানীয় প্রশাসনও, যারা নোটিশ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে। দোষী সেই রাজউক, যারা আবাসিক এলাকায় ফ্যাক্টরি উঠতে দেখেও চুপ থেকেছে। দোষী সেই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, যারা এই অবৈধ গুদাম থেকে “মাসোহারা” নিয়েছে। এবং শেষ পর্যন্ত, দোষী আমরা সবাই যারা প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পর কয়েক দিনের জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করি, তারপর ভুলে যাই।

অন্তর্বর্তী সরকারের সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ ঘটনাস্থলে গিয়ে বলেছেন, “জনবহুল এলাকায় রাসায়নিক গুদাম চলতে পারে না।” কিন্তু প্রশ্ন হলো, এতদিন কীভাবে চলছিল? কেন আগে কেউ তা বন্ধ করেনি?

তদন্ত কমিটি হয়েছে সাত সদস্যের। তারা সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে। আমরা জানি, হয়তো আবারও একটি “কারণ অজানা” রিপোর্ট আসবে, হয়তো কিছু নাম কাগজে উঠবে, কিন্তু আদালতে যাবে না। কেউ গ্রেপ্তার হলেও জামিনে বেরিয়ে আবার ব্যবসা শুরু করবে অন্য নামে।

ঢাকা মেডিকেলে এখনো শুয়ে আছে পুড়ে যাওয়া অচেনা দেহগুলো। সুরতহাল রিপোর্টে তারা কেবল “নম্বর-১”, “নম্বর-২”, “নম্বর-৩” হিসেবে লেখা। অথচ তাদের ছিল নাম, স্বপ্ন, পরিবার। ফারজানা (১৫), নার্গিস (১৮), মাহিয়া (১৪) তারা ছিল আমাদেরই বোন, যারা প্রতিদিন গার্মেন্টসের মেশিনে ঘাম ঝরিয়ে দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখে। তাদের মৃত্যুর দায় কে নেবে? একটি ২ লাখ টাকার চেক? নাকি একটি শোকবার্তা?

আজও রূপনগরের বাতাসে বিষাক্ত ক্লোরিন ও সালফারের গন্ধ। স্থানীয়রা বলছেন, চোখ জ্বলে, গলা পোড়ে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কিন্তু প্রশাসন বলছে, “পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে।” সত্যি? যদি নিয়ন্ত্রণে থাকত, তাহলে কেন আজও শিয়ালবাড়ীর শিশুদের স্কুল বন্ধ, কেন মানুষ ঘরে বন্দি?

এই শহরের প্রতিটি অগ্নিকাণ্ড যেন আমাদের বিবেকের আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। কিন্তু সে আগুনও দ্রুত নিভে যায়। কারণ আমরা অভ্যস্ত মরলে খবর হয়, বাঁচলে খবর হয় না।

রূপনগরের এই আগুন নিভে যাবে, কিন্তু ধোঁয়াটা থেকে যাবে আমাদের ইতিহাসে। সেই ধোঁয়ার মধ্যে হারিয়ে যাবে ১৬টি শ্রমিক জীবনের গল্প, আর আমরা অপেক্ষা করব পরের আগুনের জন্য।

রূপনগরের আগুন শুধু কয়েকটি ভবন পুড়ায়নি, পুড়িয়ে দিয়েছে আমাদের প্রশাসনিক কাঠামোর মুখোশ, রাষ্ট্রের দায়বোধ, আর নাগরিক নিরাপত্তার বিশ্বাস। যদি এই অগ্নিকাণ্ড থেকেও আমরা শিক্ষা না নিই তাহলে নিশ্চিত থাকুন, পরবর্তী আগুনটি আরও ভয়াবহ হবে। তখন হয়তো শিরোনাম হবে, “আরেকটি রূপনগর, আরেকটি দুর্ঘটনা, আরেকটি অবহেলার মৃত্যু।”

ওমর ফারুক
গণমাধ্যম কর্মী