ঢাকা, রোববার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫

২৩ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

ন্যায় ব্যর্থ হলে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রও ভেঙে পড়ে: প্রধান বিচারপতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮:৫৫, ২৫ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ১৮:৫৮, ২৫ অক্টোবর ২০২৫

ন্যায় ব্যর্থ হলে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রও ভেঙে পড়ে: প্রধান বিচারপতি

ছবি: সংগৃহীত

আইন কেবল নিয়মের সমষ্টি নয়, এটি একটি জাতির নৈতিক বিবেকের প্রতিফলন। ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হলে রাষ্ট্র দৃঢ় হয়, আর ন্যায় ব্যর্থ হলে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রও ভেঙে পড়ে—এমন মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ।

শনিবার (২৫ অক্টোবর) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

প্রধান বিচারপতি বলেন, “মানবতা যখন অবিচার ও অমানবিক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভয়াবহ পরিণতি প্রত্যক্ষ করে, তখনই মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা মানবজাতিকে নতুন এক নৈতিক চেতনার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। যখন রাষ্ট্র নাগরিকদের মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তখন ন্যায়ের জন্য লড়াই করা নৈতিকভাবে অপরিহার্য হয়ে পড়ে।”

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন কেবল ভাষার নয়, ছিল ন্যায়, মর্যাদা ও অস্তিত্বের অধিকারের সংগ্রাম। একইভাবে ১৯৭১ সালে বাঙালি লড়েছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি মর্যাদা, সমতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের জন্য।

বিচার বিভাগ সংস্কারের প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা বাস্তবায়নে প্রশাসনিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ, নৈতিকভাবে সাহসী ও সংবিধানিকভাবে শক্তিশালী বিচার বিভাগ গড়ে তুলতে হবে।’

তিনি জানান, দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তিনি বিচার বিভাগ সংস্কারের একটি ‘রোডম্যাপ’ ঘোষণা করেছেন। এর মূল উদ্দেশ্য হলো পৃথক সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা। ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫ বিগত ১৫ মাসের সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা ও বহুপাক্ষিক উদ্যোগের ফল,’ বলেন প্রধান বিচারপতি।

সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের প্রতি সতর্কবার্তা দিয়ে তিনি বলেন, কোনো ধরনের অবিশ্বাস বা একতরফা আচরণ গত ১৫ মাসের নিরলস প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতার ভিত্তিকে দুর্বল করে দিতে পারে। বিচার বিভাগের স্থায়িত্ব রক্ষায় পারস্পরিক বিশ্বাস ও সমন্বয়ের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।

আইনজীবী, শিক্ষাবিদ ও নবীন আইনস্নাতকদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আইনের অধ্যয়ন কেবল পেশাগত প্রশিক্ষণ নয়, এটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সাধনা। প্রত্যেক আইনের পেছনে আছে একটি জীবন, প্রত্যেক রায়ের পেছনে আছে একটি ভাগ্য।’

প্রযুক্তিনির্ভর বিচার ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, ‘একবিংশ শতাব্দীতেও আমরা ঔপনিবেশিক কাঠামোর উত্তরাধিকার বহন করছি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডেটা-নির্ভর ব্যবস্থাপনা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে বিচারব্যবস্থাকে সময়োপযোগী করতে হবে।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান স্মরণ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় অসংখ্য প্রাজ্ঞ আইনবিদ তৈরি করেছে। ভবিষ্যতেও এখান থেকে এমন আইনজ্ঞ তৈরি হবে, যারা জ্ঞান ও মানবিকতায় আলোকিত হবে।

বক্তব্যের শেষাংশে তিনি বলেন, ‘ন্যায়বিচারের পুনর্জাগরণ এখন আমাদের সময়ের আহ্বান। সংবিধানের স্বাধীনতা, সমতা ও ন্যায়বিচারের অঙ্গীকার যেন দেশের প্রতিটি নাগরিকের দোরগোড়ায় পৌঁছে যায় এটাই আমাদের দায়িত্ব।’

অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ্ হাসান নকীব। তিনি বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই আইন বিভাগ ছিল অন্যতম। আইন মানুষের আচরণ ও সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে, কারণ মানব আচরণ সবসময় পূর্বানুমান করা যায় না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনগুলো তাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করে না। এগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে, কারণ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন হলো দেওয়ার জায়গা, পাওয়ার নয়।’

এসময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি এসএসহ অন্যান্য বিচারপতি, শিক্ষাবিদ ও সাবেক শিক্ষার্থীবৃন্দ।