ঢাকা, রোববার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫

২৩ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

এশিয়ায় ট্রাম্পের সফর, আসছে কি ঝুঁকি বার্তা

আন্তর্জাতিক প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২:৫৫, ২৬ অক্টোবর ২০২৫

এশিয়ায় ট্রাম্পের সফর, আসছে কি ঝুঁকি বার্তা

ছবি: সংগৃহীত

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সফর শুরু হয়েছে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে ৪৭তম আসিয়ান সম্মেলনে যোগদানের মধ্য দিয়ে। সফরটি এমন সময়ে হচ্ছে, যখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া মার্কিন-চীনা বাণিজ্যযুদ্ধের চাপের মধ্যে নিজেদের কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করছে। প্রায় ৬৮ কোটি মানুষের এই অঞ্চল বর্তমানে বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনৈতিক কেন্দ্র হলেও, যুক্তরাষ্ট্রের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি এবং নতুন শুল্ক আরোপের কারণে অঞ্চলটির বাণিজ্যব্যবস্থা ও রপ্তানি খরচ উভয়ই চাপের মুখে পড়েছে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করে আসছে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের আগ্রাসী শুল্কনীতি- যেখানে ১০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কর আরোপ করা হয়েছে-চীনের প্রভাব কমানোর পরিবর্তে বরং আসিয়ান দেশগুলোকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলো, যারা যুক্তরাষ্ট্রে ইলেকট্রনিক্স ও বস্ত্র রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল, তারা এখন ক্রমেই চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলছে।

ট্রাম্পের এশিয়া সফরের কৌশল স্পষ্ট- বহুপাক্ষিক আলোচনার পরিবর্তে তিনি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও চাপ প্রয়োগের রাজনীতিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। মালয়েশিয়া, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় তার সফরসূচি তা-ই নির্দেশ করছে। কুয়ালালামপুরে কম্বোডিয়া–থাইল্যান্ড যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে অংশগ্রহণ করে তিনি নিজেকে ‘চুক্তিনির্মাতা’ বা ‘শান্তির মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইছেন। একই সঙ্গে তিনি সরবরাহ শৃঙ্খলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বাড়ানোর বিনিময়ে আসিয়ান দেশগুলোর জন্য শুল্ক ছাড়ের প্রস্তাব দিচ্ছেন।

চীনের প্রধানমন্ত্রী লি চিয়াংয়ের সঙ্গে তার পার্শ্ব বৈঠকে বাণিজ্য যুদ্ধ প্রশমনের ইঙ্গিত থাকলেও, এর বাস্তব ফলাফল এখনো অনিশ্চিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্পের কৌশল- কঠোর হুমকি ও ব্যক্তিগত প্রশংসার মিশ্রণ-স্বল্পমেয়াদে কিছু সাফল্য এনে দিতে পারে, কিন্তু তা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়। যুক্তরাষ্ট্রের চাপ প্রয়োগমূলক নীতি অনেক সময় মিত্র দেশগুলোকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়, ফলে তারা চীনের সঙ্গে নতুন বাণিজ্যিক ও কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তুলতে বাধ্য হয়।

এই সফর থেকে যুক্তরাষ্ট্র কিছু তাৎক্ষণিক সুবিধা পেতে পারে। যেমন, প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলারের সম্ভাব্য শুল্কমুক্ত বাণিজ্য চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন নেটওয়ার্ককে শক্তিশালী করবে, এবং ফিলিপাইনের জন্য স্থগিত থাকা ৩৩৬ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা পুনরায় চালু হলে নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার হবে। তবে এসব সাফল্যের পাশাপাশি ঝুঁকিও বড়। শুল্কনীতির কারণে আসিয়ান দেশগুলো চীনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, নতুন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করছে এবং ভারত, কানাডা ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো নীতির ধারাবাহিকতার অভাব। ওয়েন্ডি কাটলারের মতে, “আমরা আমাদের সফট পাওয়ারের অনেকটাই হারিয়েছি; বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা যুক্ত হলে আসিয়ান দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে আর দেখে না।” একইভাবে গ্রেগ পোলিং বলেন, ‘ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনের মতো দেশগুলো চীনের প্রতি অনুকূল নয়, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও চীন—উভয়কেই এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়।’ এই বাস্তবতা ট্রাম্পের নীতি বাস্তবায়নকে আরও জটিল করে তুলছে।

সর্বশেষ বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ট্রাম্পের এই সফর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব আংশিকভাবে পুনরুদ্ধার করতে পারলেও তা স্থায়ী প্রভাব ফেলবে না, যদি না যুক্তরাষ্ট্র তার নীতিতে ধারাবাহিকতা ও আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে। স্বল্পমেয়াদি কূটনৈতিক সাফল্যের পেছনে লুকিয়ে আছে দীর্ঘমেয়াদি আঞ্চলিক অস্থিরতার ঝুঁকি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এখন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কেবল এক কৌশলগত মঞ্চ নয়, বরং বিশ্বাস ও স্থিতিশীলতার পরীক্ষাগার। আর যদি ট্রাম্প প্রশাসন সেই আস্থা পুনর্গঠন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আসিয়ান দেশগুলো অনিবার্যভাবেই চীনের দিকে আরও ঝুঁকবে—যার ফল যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রভাব হ্রাসের দিকেই যাবে।

এ সম্পর্কিত খবর