আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২২:৩১, ১৯ অক্টোবর ২০২৫
রাকের প্রভাবশালী শিয়া ধর্মীয় নেতা মুকতাদা আল-সদর। ছবি: সংগৃহীত
ইরাকের প্রভাবশালী শিয়া ধর্মীয় নেতা মুকতাদা আল-সদর আসন্ন নভেম্বরের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘দেশকে বাঁচাতে এবং রাজনৈতিক মুখ বদলাতে’ তিনি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এটি তার দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের অংশ—রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ব্যর্থতার পর নিজের শক্তিশালী প্রত্যাবর্তনের পথ তৈরি করা।
তিন বছরের ‘অপেক্ষা’ শেষের পথে
২০২২ সালের জুনে নিজের রাজনৈতিক জোটকে পার্লামেন্ট থেকে প্রত্যাহার করার পর আল-সাদর দাবি করেন, তিনি ‘পুরো ব্যবস্থার সংস্কার’ চান। যদিও তার সমর্থকরা গোপনে সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনে ফেরার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত শাসক জোট শিয়া কো-অর্ডিনেশন ফ্রেমওয়ার্ক (এসসিএফ) সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
একজন ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, সাদর প্রথমে নির্বাচনে ফেরার বিষয়ে অনিচ্ছুক ছিলেন, কিন্তু তার দলীয় নেতারা চাপ দিলে তিনি শর্তসাপেক্ষে অংশগ্রহণে রাজি হন। তবে পরবর্তীতে তিনি নিজেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাতে লেখা বার্তায় “#বয়কট” হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে আলোচনা বন্ধের ঘোষণা দেন।
২০২২ সালের ব্যর্থতা ও ‘জাতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ’ সরকার
মুকতাদা আল-সাদর ২০২২ সালে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বর্জন করেন যখন তার “জাতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার” গঠনের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। ২০০৬ সাল থেকে চালু ‘মুহাসাসা’ পদ্ধতিতে ইরাকের ক্ষমতা বণ্টিত হয় ধর্ম ও জাতিগত অনুপাতে, যেখানে প্রতিটি দল সরকারে অংশ পায়। সাদর এই পদ্ধতির বিরোধিতা করে শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে সরকার গঠনের দাবি তোলেন।
২০২১ সালের নির্বাচনে তার দল ৩২৯ আসনের মধ্যে ৭৩টি পায়। কুর্দিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (কেডিপি), সুন্নি নেতা মোহাম্মদ আল-হালবুসি এবং অন্যদের সঙ্গে মিলে তিনি ১৭৫ আসনের জোট গঠন করেন, যার নাম ছিল “ইনকাজ ওয়াতান” (দেশ বাঁচাও)। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ কোরাম বাধ্যতামূলক হওয়ায় এই জোট সরকার গঠনে ব্যর্থ হয়। এরপর প্রতিদ্বন্দ্বী এসসিএফ ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং মোহাম্মদ শিয়া আল-সুদানিকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করে।
রাস্তার রাজনীতি থেকে সংসদবহির্ভূত প্রভাব
সরকার গঠনে ব্যর্থ হয়ে সাদর তার সমর্থকদের নিয়ে বাগদাদের গ্রীন জোনে বিক্ষোভ শুরু করেন, যা পরে সংঘর্ষে রূপ নেয়। তিনি পরে টেলিভিশন ভাষণে সহিংসতা থামানোর আহ্বান জানান। তবুও, তার প্রভাব তখনো রাজনীতির বাইরে রয়ে যায়নি। ২০০৬ সাল থেকে প্রতিটি ইরাকি সরকারেই কোনো না কোনোভাবে সাদরপন্থীরা প্রভাব বিস্তার করেছে।
এসসিএফ সরকারের সঙ্কট
এসসিএফ ক্ষমতায় এসে সাদরপন্থী কর্মকর্তাদের অপসারণ করে, এমনকি বিচার বিভাগকেও রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার অভিযোগ ওঠে। এদিকে সরকার অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে—২০২৫ সালের প্রথমার্ধে তেল রাজস্বের প্রায় ৯৯ শতাংশই ব্যয় হয়েছে বেতন, পেনশন ও সামাজিক খাতে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও ইসরায়েলি হুমকিতে দেশটির ওপর চাপ বাড়ছে।
নতুন কৌশল: ‘দেশপ্রেমিক শিয়া কারেন্ট’
২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে আল-সাদর তার সংগঠনের নাম বদলে রাখেন ‘প্যাট্রিয়টিক শিয়া কারেন্ট’। এ উদ্যোগের মাধ্যমে তিনি নিজেকে ধর্মীয় অথচ সংস্কারপন্থী নেতার রূপে উপস্থাপন করছেন। সম্প্রতি আশুরা উপলক্ষে তিনি বাগদাদের তাহরির স্কয়ার ও নাসিরিয়াহর হাবুবি স্কয়ারে তীর্থযাত্রীদের জন্য তাবু স্থাপন করেন—যে পদক্ষেপ কোনো রাজনৈতিক দল আগে নেয়নি।
আঞ্চলিক রাজনীতিতেও সাদর এখন নিরপেক্ষ অবস্থান নিচ্ছেন। তিনি সিরিয়ায় সরকার পরিবর্তনকে সমর্থন করেছেন, তবে গাজা যুদ্ধের বিষয়ে কেবল মানবিক অবস্থান নিয়েছেন—যা পশ্চিমা শক্তি ও উপসাগরীয় দেশগুলোর কাছে তাকে একটি “গ্রহণযোগ্য বিকল্প” হিসেবে উপস্থাপন করছে।
শেষ খেলা কী?
ইরাক যদি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অচলাবস্থায় পড়ে, তবে মুকতাদা আল-সাদর ও তার প্যাট্রিয়টিক শিয়া কারেন্ট সেই শূন্যস্থান পূরণে প্রস্তুত—এই ধারণাই এখন রাজনৈতিক মহলে সবচেয়ে আলোচিত।